আঁধারে আলো
– পায়েল সাহু
মাঝে মাঝেই আজকাল সহ্যশক্তি ছাড়িয়ে যায় রুদ্রর ব্যবহার তবু মুখ বুজে সহ্য করতে করতে রুমা ভাবে একদিন সে সব কিছুর জবাব ঠিক দেবেই। অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নেয়। অনেক সময় রুদ্রর কথাও ভাবে, এই অতিমারীর সময় লকডাউনে কারখানার কাজটা হারিয়ে দিনের পর দিন বাড়ি বসে অভাবের সংসারে কারই বা মাথার ঠিক থাকে। সরকারের দেওয়া রেশনে কোনো মতে দিন গুজরান হচ্ছে। তার মধ্যেই নেশার খোরাকি ঠিক আছেই। তবু আনমনে তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে অতীতের কথা ভেবে।
বাড়ি থেকে পালিয়ে সামান্য কারখানায় কাজ করা অনাথ যুবক রুদ্রকে ভালোবেসে বিয়ে করার ঠিক দু বছরের মাথায় একটি বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলের চাকরিটা পেয়ে রুমা ভেবেছিলো তাঁদের অভাবের সংসারের এবার একটু সুরাহা হবে। স্বনির্ভর হওয়ার আনন্দে সারাদিন অজস্র পরিকল্পনা করছিলো রুমা। কিন্তু খুশি হতে পারেনি রুদ্র, কোনো যুক্তি না দেখিয়েই সরাসরি বারণ করে দিয়েছিলো। রুমার হাজার অনুরোধ, কান্না কোনোকিছুই রুদ্রর মন গলাতে পারেনি বরং যতদিন গেছে রুদ্র ভীষণ ভাবে অচেনা হতে থাকে রুমার কাছে। মদের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে সবসময়। সামান্য কথার অবাধ্য হলেও গায়ে হাত তুলতে অব্দি দ্বিধা করতো না রুদ্র। হয়তো রুমার স্বাবলম্বী হতে চাওয়াটা তার অকর্মণ্যতাকে ভীষণ স্পষ্ট করে তুলেছিল।
রুদ্র কারখানায় কাজ করলেও স্বপ্ন দেখতো অনেক বড়ো। লটারীর টিকিট কাটার নেশায় পেয়ে বসেছিল তাকে। অতি সামান্য আয়ের বেশিরভাগটাই চলে যেতো লটারির টিকিটের পেছনে। কখনো কখনো দু’ পাঁচশো টাকা পেয়ে গেলে তাকে আর পায় কে। আর সেই রাতগুলোতে চলতো রুমার ওপর পাশবিক অত্যাচার|
এই পরিস্থিতিতে রুমা একটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে সে কোনোদিন মা হবে না, নিজের সন্তানের কাছে রাতদিন চোখের জলে ভেসে ছোট হতে পারবে না | এই ব্যাপারটা আজও গোপন থেকে গেছে রুদ্রর কাছে।
দম দেওয়া পুতুলের মতো রুদ্রর বাধ্য হয়ে কাটিয়ে দিলো এতগুলো বছর। রুদ্রর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কটাও তলানিতে এসে ঠেকেছে, কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে চলছে।
মাঝে মধ্যেই পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে পড়লে নিজেই অবাক হয়ে যায়, রুদ্রর সামান্য অসম্মানে গা জ্বলতো রুমার আর আজ রুদ্রর যে কোনো শারীরিক কষ্ট বা বাড়ি বয়ে রুদ্রর কাছে টাকার তাগাদা করতে আসা মহাজনের অপমানে রুমার মনে অদ্ভুত একটা আনন্দের সঞ্চার করে।
ভয়ংকর একটা প্রতিহিংসার আগুন জ্বলতে থাকে আপাত নিরীহ প্রতিদিন অত্যাচারিতা রুমার মনে। যদিও সবটুকুই মনের চৌহদ্দিতেই সীমাবদ্ধ থাকে।
মন খারাপ লাগলেই বাড়ির কাছেই দক্ষিনেশ্বরের গঙ্গার ঘাটে এসে বসে রুমা, ওই উথাল পাথাল জলের গভীরতায় বিসর্জন দিয়ে আসে সব দুঃখগুলো। মা বাবার একমাত্র মেয়ে ছিলো রুমা, অতি আদরে কেটেছে ছোটবেলাটা, বিলাসিতা না হলেও অভাব ছিলো না কোনোকিছুর, এমনকি রান্না অব্দি করতে শেখেনি কোনোদিন ভালো করে। খুব সুন্দর গান গাইতে পারতো রুমা, ভেবেছিল গানের স্কুল খুলবে ভবিষতে।
সেই মেয়ে মা বাবাকে লুকিয়ে এক কাপড়ে চলে এসেছিলো রুদ্রর হাত ধরে।
সময়ের সাথে সাথে মা বাবা রুদ্রকে মেনে নিলেও রুদ্র কোনোদিনই আপন করেনি তাঁদের। এমনকি রুমারও বাপের বাড়ি যাওয়ায় কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিলো। তবু রুমা কখনো কখনো লুকিয়ে চলে যেতো মায়ের কাছে।
মেয়ের জন্য দুবেলা চোখের জলে ভাসেন তাঁরা। রুমার পরিস্থিতির কথা জেনে অনেকবার তাঁরা অনুরোধ করেছেন ফিরে আসার জন্য, কিন্তু রুমা রাজি হয়নি।
আজ একটু বেলার দিকে বাজার গেছিলো রুমা একটি সংস্থার দেওয়া ত্রাণ আনার জন্যে, ফেরার পথে রোদ এড়াতে গলি পথ দিয়ে ফিরছিলো বাড়ি। “দিদি ও দিদি আমার মেয়েটাকে বাঁচান দিদি” বলে আচমকাই এক মুখে মাস্ক ঢাকা এক মহিলা ছুটে এসে রুমার পায়ের কাছে একটা পুঁটুলি ফেলে রেখে কোথায় যেন ছুটে চলে গেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় রুমা তখন দিশেহারা। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরলো বাচ্চার কান্নার আওয়াজে। তড়িঘড়ি হাতে ধরা ত্রাণের ব্যাগ ফেলে রেখে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নেয় রুমা। মাস তিনেকের বাচ্চাটি কোলের ওম পেয়ে কান্না ভুলে হেসে ওঠে রুমার দিকে তাকিয়ে।
সন্তান স্নেহে উথলে ওঠে রুমার মাতৃ হৃদয়। ভীষণ এক ভালোলাগা ঘিরে ধরে তাকে। আশেপাশে কিছুক্ষণ খুঁজেও মহিলাটিকে আর দেখতে না পেয়ে কোনো কিছু না ভেবে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসে বাচ্চাটিকে নিয়ে।
একে এই ভয়ংকর অতিমারী পরিস্থিতি, পুলিশে জানালে এই বাচ্চাকে যদি কোনো হোমে নিয়ে যায় আর সেখানে ঠিকমতো যত্ন না হয়? যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে? না না, রুমা কাউকে দেবে না এ মেয়েকে, ও বুকে করে আগলে বড়ো করবে। এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ের পরিচর্যায় মেতে ওঠে নতুন মা।ছোট্ট মেয়ের নাম দেয় “রেনিসা” কিন্তু সন্ধ্যে গড়াতেই দুশ্চিন্তায় মুখ কালো হয়ে যায় রুমার। রুদ্রকে কি বলবে সে? যদি মেনে না নেয়? যদি পুলিশে খবর দেয়? যদি মারধর করে রুমাকে?
কিন্তু রুমা যে এই একরত্তি মেয়েকে কাছছাড়া করতেই পারবে না। যখন এই মেয়ের আসল মা এসে মেয়েকে ফেরত চাইবে তখন কি করবে সে? নানারকম চিন্তায় মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকে সে।
বেশ অনেক রাতে প্রচন্ড নেশাগ্রস্ত হয়ে রুদ্র ফিরলো বাড়িতে। রাতে কিছু বুঝতে না পারলেও সকালে প্রচন্ড চমকে গেলো বাচ্চাটাকে দেখে।
যথারীতি অশান্তি শুরু করে দিলো। কিন্তু রুমার জেদের কাছে হার স্বীকার করতে বাধ্য হলো তখনকার মতো।
রুমা ভাবলো রুদ্র হয়তো মেনে নিলো বাচ্চাটিকে, কিন্তু রুমার ভাবনা যে কতোটা ভুল, তার চরম প্রমাণ পেলো এক সপ্তাহ পরেই।
“কাল সকালে বাচ্চাটাকে সকাল সকাল তৈরি করে দেবে, ওকে নিয়ে এক জায়গায় যাবো” রুদ্রর এই কথায় অবাক হয়ে যায় রুমা।
-“এই করোনা পরিস্থিতিতে ছোট বাচ্চাকে নিয়ে তুমি কোথায় ঘুরতে যাবে? এই কদিনে একবারও তো কোলে নাও নি!” রুমার কথার উত্তরে রুদ্র আবার বলে ওঠে, “এক নিঃসন্তান দম্পতির সঙ্গে কথা বলেছি, এই বাচ্চাটার বিনিময়ে দু’ লক্ষ টাকা দেবেন ওনারা, খুব বড়ো লটারী পেয়ে গেছি আমি, এই করোনা পরিস্থিতি চলুক কতদিন চলবে, আমার চিন্তা নেই, ঘরে বসে লাখপতি হয়ে দিন কাটাবো রাজার হালে..” বলে হা হা করে হাসতে থাকে রুদ্র।
“নাআআআ কক্ষনো নয়, এ মেয়ে আমার কাছে গচ্ছিত, ওর মা যখন ফেরত চাইতে আসবে, কি জবাব দেব আমি তাকে?” গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে রুমা।
“কি বললি? আমার হাতের লক্ষ্মী কেড়ে নিবি তুই? আজ তোকে মেরেই ফেলবো” বলে অকথ্য অত্যাচার চালায় সেদিন রুদ্র। রুমার চিৎকারে পাড়া প্রতিবেশীরা ছুটে এসে বাঁচায়।
যদিও রুদ্রর তাতে হেলদোল নেই বিশেষ।আকণ্ঠ পান করে রুমাকে আরো একবার হুমকি দিয়ে শুয়ে পড়ে সেদিনের মতো।
সারারাত মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকে রক্তাক্ত রুমা। তার এই একরত্তি মেয়েই তার জীবনের নতুন আলোর দিশা, মেয়ের জন্যই ওকে বাঁচতে হবে। মেয়েকে রক্ষা করতেই হবে। সব অত্যাচারের জবাব দিতেই হবে এবার। গত পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে অনেক আগেই যে দৃঢ় পদক্ষেপ রুমার নেওয়া উচিৎ ছিলো আজ তার ছোট্ট মেয়ে সেই মনোবল জুগিয়েছে ওকে। ভোর রাতে উঠে মেয়ে নিয়ে রওনা হয় পুলিশ স্টেশনের দিকে। রুদ্রর বিরুদ্ধে 498(A) ধারায় case দিয়ে পুলিশের সহায়তায় পৌঁছে যায় তার বাপের বাড়ি।
বাবা মা যেন রুমাকে ফিরে পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পান।
রুমার কোলে ছোট্ট রেনিসাকে দেখে আনন্দের হাট বসে যায় বাড়িতে |
এই ভয়ংকর অতিমারী হাজার হাজার মানুষের প্রাণঘাতী হয়েও জাগিয়ে তুলেছে মানুষের মধ্যে প্রাণপণ বাঁচার আশা। সব খারাপই খারাপ নয়, কিছু ভালো চেতনার উপহারও বটে।
খুব ভালো লেগেছে
অনেক ধন্যবাদ